দেশের ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক স্কুলে বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য কেনা ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বইয়ের মেধাস্বত্ব নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠার পর নড়েচড়ে বসেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি পুরো ঘটনাটি তদন্ত করবে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায় কতটুকু তা কমিটি খুঁজে বের করবে।
এদিকে বই কেনায় গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থান সংসদীয় কমিটির কাছে ব্যাখ্যা করেছেন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম আল হোসেন। ব্যাখ্যা সন্তোষজনক হলেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কীভাবে এ বই অন্যকে বিক্রির অনুমতি দিয়েছে তার ব্যাখ্যা চাইতে পারে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, গত বুধবার (২৬ আগস্ট) বেশকটি এজেন্ডা নিয়ে বৈঠকে বসেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির সদস্যরা বঙ্গবন্ধু কর্নারের বই নিয়ে ব্যাখ্যা চাইলে মন্ত্রণালয়ের সচিব পুরো কেনাকাটা বিষয়টির ব্যাখ্যা দেন। এতে কমিটির সদস্যরা সন্তুষ্ট হন। তখন সচিব অধিকতর তদন্তের জন্য সংসদীয় কমিটিকে অনুরোধ করেন।
পরে কমিটি সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুকে আহ্বায়ক করে একটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়। উপ-কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— আলী আজম, শিরীন আখতার ও মো. মোশাররফ হোসেন। তারা এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের দায় খুঁজে বের করবেন।
উপ-কমিটির সদস্য মোশাররফ হোসেন বলেন, সচিব তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। এতে আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি। যেহেতু বইয়ের মেধাস্বত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তাই আমরা অধিকতর তদন্ত করবো। কোনো সময় বেধে দেয়া না হলেও দ্রুত প্রতিবেদন দেয়ার চেষ্টা করবেন বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ করার নামে কর্মসূচি নেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে প্রায় দেড়শ কোটি টাকার বই কেনার পরিকল্পনা করেছিল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। তখন সিদ্ধান্ত ছিলো যে, একজন লেখকের একটি করে বই ৬৫ হাজার কপি করে কিনে স্কুলে বিতরণ করা হবে।
চলতি বছর শিশু একাডেমিকেও বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখা ৩৮টি বই কেনার অনুমতি দেয় গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই তালিকায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বই ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বইটি নির্বাচিত হয়। বইটির মেধাস্বত্ব অন্যের নামে চালিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে জার্নি মাল্টিমিডিয়া লিমিটেডের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটি বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য ৬৫ হাজার বই সরবরাহ করে ১২ কোটি ৯৭ লাখ টাকার বিল জমা দিয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ বই সরবরাহের জন্য জার্নি মাল্টিমিডিয়া ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চুক্তি হয় চলতি বছরের ১৬ জুন। চুক্তির আগে বইয়ের স্বত্ব যাচাই করতে দুই দফা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এনওসি পাওয়ার পর চুক্তি হয়।
বিভিন্ন চিঠি সূত্রে জানা গেছে, জার্নি মাল্টিমিডিয়া এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বই বিক্রির মোট ১১ কোটি দুই লাখ ৯৯ হাজার টাকার মধ্যে ২৩ শতাংশ রয়্যালিটি— দুই কোটি ৫৩ লাখ ৪৮ হাজার টাকা অগ্রিম পরিশোধ করার পর প্রতিষ্ঠানটিকে গত ৩ জুন বই বিক্রির এনওসি দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর ১ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে চুক্তি সঠিক কি না জানতে চেয়ে চিঠি দেন।
২৩ শতাংশ রয়্যালিটি হিসেবে আড়াই কোটির বেশি টাকা বুঝে পেয়েছেন— এমন সত্যতা নিশ্চিত করে এরপর ৮ আগস্ট চিঠির জবাব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বই কিনতে প্রাথমিক গণশিক্ষা অধিদপ্তরকে অনুমতি দেয়।
এরপর গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে ফের চিঠি দেয় বইয়ের মালিকানা স্বত্ব সঠিক আছে কি না জানার জন্য। সেই চিঠির সত্যতা স্বীকার করে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর জার্নি মাল্টিমিডিয়াকে
কাজ দেয়া হয়।
এ ব্যাপারে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম আল হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তার দায় গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় একাধিক চিঠি দিয়ে স্পষ্ট হওয়ার পরই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়। পরবর্তীতে বই নিয়ে যা হয়েছে তাও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা শুধু বই কিনেছি। ক্রেতা হিসেবে এর বেশি দায় মন্ত্রণালয়ের ওপর বর্তায় না। গত বুধবার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সংক্রান্ত প্রশ্ন উত্থাপিত হলে আমি পূর্ণাঙ্গ একটি ব্যাখ্যা দিয়েছি। এতে কমিটি সন্তুষ্ট। সঠিক তদন্তে হলেই এর দায় কার তা বেরিয়ে আসবে। অধিকতর তদন্তের জন্য আমি সংসদীয় তদন্ত কমিটিকে অনুরোধ করি এবং সেটা গ্রহণ করে কমিটি গঠন হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, জার্নি মাল্টিমিডিয়া ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বইয়ের শতভাগ মালিকানা স্বত্ব আছে মর্মে কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রেশন সনদ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এনওসি দেখার পর প্রতিষ্ঠানটিকে ৬৫ হাজার ৭০০ কপি সরবরাহের জন্য দরপত্র দাখিল করে।
সবকিছু যাচাই-বাছাই করে বইটির মূল্য এক হাজার ৯৭৫ টাকা দাম নির্ধারণ করে ১৬ জুন কাজ দেয়া হয়। পুরো বই সরবরাহ করার পর ১২ কোটি ৯৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা বিল দাখিল করেছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে বই সরবরাহ করতে জার্নি মাল্টিমিডিয়া স্যাম্পল বই দেয়। তাতে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দেখেন, প্রিন্টার্স লাইনে প্রকাশনা, প্রকাশক, সমন্বয়ক, গবেষক, উপদেষ্টা, সম্পাদনা পর্ষদ, গবেষণা, প্রচ্ছদ ও শিল্প নির্দেশনা, অঙ্গসজ্জা মুদ্রণ ইত্যাদি পরিবর্তন রয়েছে।
এছাড়া কিছু বইয়ে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজের লগো দেয়া হয়েছে। এসব পরিবর্তন দেখতে পেয়ে ফটোকপি সংযুক্ত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় অধিদপ্তর। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে অবগত করে চিঠি দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এসব বিষয় গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজরে আসার পর পরিবর্তনের ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমতি আছে কি না তা জানতে চিঠি দেয়া হয়।
চিঠিতে আরও জানতে চাওয়া হয়, বইয়ে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে সে বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন আছে কি না এবং বইয়ের মূল্য বাবদ ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ ১২ কোটি ৯৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা পরিশোধ করতেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সম্মতি চাওয়া হয়। যেই চিঠির জবাব এখনো তারা পায়নি।
এ ব্যাপারে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, বইয়ে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে তা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অগোচরে হয়েছে। যখনই নজরে এসেছে তখনই বইয়ের মূল মালিক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। এখানে প্রাথমিক মন্ত্রণালয়ের কোনো দায় নেই।
জানা গেছে, ‘বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা’ বইয়ের সম্পাদক অমিতাভ দেউরী অভিযোগ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বইটি আমি সম্পাদনা করি। কিন্তু আমাকে কোনো ধরনের তথ্য না দিয়ে জার্নি মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার তার নিজের স্ত্রীকে প্রধান গবেষক ও সমন্বয়ক-প্রকাশক হিসেবে নাম দেখিয়েছে। এমনকি গোপনে বইয়ের কপিরাইটও তার নামে করিয়ে নিয়েছেন।
এর প্রতিকার চেয়ে আমি কপিরাইট অফিসে বইটির কপিরাইট বাতিলের আবেদন করেছি, প্রতিষ্ঠানকে এসব জালিয়াতির ব্যাখ্যা চেয়ে উকিল নোটিস পাঠিয়েছি।
এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত শুরু করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সংসদীয় কমিটি। তদন্তের মাধ্যেমে সব পরিষ্কার হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রকাশনা আইন অনুযায়ী বইয়ের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা বা বিতর্ক হলে তার দায় লেখক বা সম্পাদকের ওপরই বর্তায়। এ বইয়ের ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা লেখকের অজান্তে। বইয়ের ভেতরে ইতিহাস বিকৃতি ঘটছে কি না তাও তদন্ত করা উঠিত।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকার সময়কাল নিয়ে লেখা ‘৩০৫৩ দিন’ বইটি বাংলাদেশ কারা কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করলেও বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য যে বই সরবরাহ করা হয়েছে সেখানে সম্পাদক হিসেবে নাজমুল হোসেন ও প্রকাশক হিসেবে তার প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
Leave a Reply