কাঁচা পাটের অভাবে কাজ হারাবে ৪ কোটি মানুষ

করোনা পরিস্থিতিতে কাঁচা পাটের অভাবে পাটশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে কর্মসংস্থান হারাবে দেশের চার কোটি মানুষ; যারা পরোক্ষভাবে পাটশিল্পের সঙ্গে জড়িত। পাটকলমালিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সূত্র জানিয়েছে, দেশের পাটকলগুলোতে বছরে পাটের চাহিদা ৬০ লাখ বেল। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ কাজে প্রয়োজন হয় আরও পাঁচ লাখ বেল কাঁচা পাট। মোট ৬৫ লাখ বেল কাঁচা পাটের চাহিদার বিপরীতে চলতি বছর দেশে উৎপাদিত কাঁচা পাটের পরিমাণ ৫৫ লাখ বেল। অর্থাৎ এ বছর চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি রয়েছে ১০ লাখ বেল কাঁচা পাটের। জানা গেছে, প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ লাখ বেল কাঁচা পাট রপ্তানি হয়ে থাকে।

সূত্র জানায়, শিলাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় আম্পান, বন্যা ও করোনার সংক্রমণ- এই পাঁচ কারণের প্রভাবে এ বছর পাটের উৎপাদন কম হয়েছে। বছরে বাংলাদেশে কাঁচা পাট উৎপাদনের পরিমাণ কমপক্ষে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ বেল। গত বছর দেশে ৮৪ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়েছিল।

সংশ্লিষ্টসূত্রে আরও জানা যায়, দেশে বর্তমানে পাটকলের সংখ্যা ২৫৯টি। এই পাটকলগুলোর সঙ্গে সরাসরি কর্মরত রয়েছেন দুই লাখ মানুষ। এ খাতে বছরে উৎপাদিত পাটপণ্যের পরিমাণ ৭ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। এর মাঝে বিদেশে রফতানি করা হয় ৬ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন পাটপণ্য। এই রফতানির বিপরীতে ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে বাংলাদেশ।

মিল মালিকরা বলছেন, এমনিতেই এবছর মিলগুলোর জন্য কাঁচা পাটের ঘাটতির পরিমাণ ১০ লাখ বেল। এ অবস্থার মাঝে যদি ১০ লাখ বেল কাঁচা পাট রপ্তানি করা হয়, তাহলে মিলগুলো কাঁচা পাটের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। বেকার হয়ে পড়বে এই শিল্পের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত চার কোটি মানুষ। দেশ হারাবে ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।

অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২ হাজার ৪০০ টাকা দরের প্রতি মণ কাঁচা পাট বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭৫০ টাকা দরে। যা সব সময়ের জন্য রেকর্ড। অতীতে প্রতিমণ কাঁচা পাটের দাম ২ হাজার ৫০০ টাকার বেশি হয়নি কখনো। তারা বলেন, এই দরে বাজার থেকে পাট কেনার পর কারখানার গুদাম পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রতিমণ পাটের দাম পড়বে ৩ হাজার ২০০ টাকা। এই টাকায় কেনা পাটে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে আমরা কোনোভাবেই ব্যবসায় টিকে থাকতে পারব না। পক্ষান্তরে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে বেকার হবে।

পাটের দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন বেসরকারি পাটকল মালিকরা। তারা বলেন, সরকার যদি আমাদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত দুটি সুপারিশ বাস্তবায়ন করে, তাহলে দেশের পাটশিল্প বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে। অন্যথায় পাটশিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে।

বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান জাহিদ মিয়া বলেন, ‘আমরা কাঁচা পাট রপ্তানির বিপক্ষে নই। তবে আমরা শুধু এ বছরটির জন্য কাঁচা পাট রপ্তানি নিরুৎসাহিত করতে দুটি অনুরোধ করেছি মাত্র। এর একটি হচ্ছে- প্রতি টন কাঁচা পাট রপ্তানিতে ২৫০ মার্কিন ডলার হারে রপ্তানি শুল্ক ধার্য করা। যাতে কাঁচা পাট রপ্তানি নিরুৎসাহিত হয়। আর দ্বিতীয় অনুরোধটি হলো- এ বছরের জন্য আনকাট বা বাংলা তোশা রেজেকশন (বিটিআর) এবং বাংলা হোয়াইট রেজেকশন (বিডব্লিউআর) জাতের পাট রপ্তানি সাময়িক বন্ধ রাখা। আমরা এই দুটি সুপারিশ করেছি।’

তিনি জানান, আগামী বছর যদি চাহিদার ৬৫ লাখ বেলের বেশি কাঁচা পাট দেশে উৎপাদিত হয়, তাহলে আবারও রপ্তানির অনুমতি দেওয়া যাবে বলেও জানান তিনি। এক মণ কাঁচা পাট রপ্তানি করে যে দাম পাব, সে ক্ষেত্রে সমপরিমাণ পাট প্রক্রিয়াজাত করে পাটপণ্য রপ্তানি করলে ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা বেশি দাম পাব বলেও জানান জাহিদ মিয়া।

বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, এখন বাজারে কাঁচা পাটের দাম প্রতি মণ সর্বোচ্চ ২ হাজার ৭৫০ টাকার মতো। মাত্র এক সপ্তাহে প্রতি মণ পাটের দাম ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা বেড়ে গেছে। ভরা মৌসুমে কাঁচা পাটের দাম ২ হাজার ৭৫০ টাকা হতে পারে, এটা আমাদের কারও অভিজ্ঞতায় নেই। এই দামে পাট কিনে পণ্য উৎপাদন শেষে যা দাম দাঁড়াবে তাতে বিদেশি ক্রেতারা কিনতে চাইবে না।

কাঁচা পাটের দাম এভাবে বাড়লে সংকট আরও বাড়বে জানিয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, সরবরাহ ঘাটতির কারণে পাটকল বন্ধ হয়ে গেলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রেতারা পাটপণ্য ব্যবহার থেকে সরে দাঁড়াবে, তা হবে দেশের পাটশিল্পের জন্য তা হবে বিপজ্জনক।

বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ফারিয়ান ইউসুফ বলেন, পাট শিল্প রক্ষায় কাঁচা পাটের বাজারদর এবং সরবরাহ সহনীয় পর্যায়ে রাখা প্রয়োজন। কাঁচা পাটের অভাবে পাটকল বন্ধ হয়ে গেলে এই শিল্পের আরও শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি হারাবে। দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, ‘অ্যাসোসিয়েশনের দাবির বিষয়টি শুনেছি। আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেব।’

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *