আ.লীগের ভাবনায় পৌর-নির্বাচন

আগামী ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে পৌরসভা নির্বাচন। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে সরগরম স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি। নৌকার মনোনয়ন পেতে মরিয়া ক্ষমতাসীন দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এমপি-মন্ত্রীসহ স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের কাছে নানাভাবে লবিং-তদবির করছেন তারা।

কেউ কেউ জনপ্রিয়তার জানান দিতে বড় বড় বিলবোর্ড ও ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে ফেলেছেন পুরো নির্বাচনি এলাকা। সকাল-সন্ধ্যায় যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন মিছিল-মিটিং ও সভা-সমাবেশে। নিজ নিজ প্রার্থীদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত কর্মী-সমর্থকরা।

এদিকে পৌরসভা নির্বাচনে ক্লিন-ইমেজ, সৎ, যোগ্য এবং সাধারণ ভোটার ও দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন দিতে চান ক্ষমতাসীন আ.লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা। জেলা-উপজেলার দায়িত্বশীল নেতাকর্মীদের কঠোর নির্দেশনা দিচ্ছেন তারা।

মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা বলছেন, চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পৌরসভা নির্বাচনে নৌকার মনোনীত প্রার্থীর জয়ের বিকল্প নেই। তাই দলের অভ্যন্তরে সৃষ্ট কোন্দল ও বলয়ভিত্তিক রাজনীতি ভেঙে দেয়া হচ্ছে।

সূত্র জানায়, দেশে মোট পৌরসভার সংখ্যা ৩২৯টি। এর মধ্যে ২৯১টি পৌরসভা ভোটগ্রহণের উপযোগী । এর মধ্যে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে মেয়াদ শেষ হবে ২৩৫টি পৌরসভার এবং এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন মেয়াদ শেষ হবে ৫৬ পৌরসভার।

আর সীমানা জটিলতা ও মামলাজনিত কারণে আপাতত নির্বাচন হচ্ছে না ৩৮টি পৌরসভায়। আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে পৌরসভা নির্বাচন করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একদিনে দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় ভোট করার চিন্তা করছে সাংবিধানিক এই সংস্থাটি। এক্ষেত্রে ভোট নিয়ে দুই ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি সচিবালয়।

প্রথমত, চলতি মাসের শেষের দিকে তফসিল দিয়ে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ ভোট করা।

দ্বিতীয়ত, ডিসেম্বরে তফসিল দিয়ে জানুয়ারিতে ভোট করার চিন্তা করা হচ্ছে। তবে তফসিল থেকে ভোট অনুষ্ঠান পর্যন্ত ৩৫-৪৫ দিন হাতে রাখবে ইসি।

আ.লীগ সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় হাইব্রিড নেতাদের উর্বর ভূমি এখন আওয়ামী লীগ। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলাপর্যায়ে ভিন্নপন্থি নেতাদের জয়জয়কার। এদের অধিকাংশ বিগত সময়ে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী ছিলেন। স্থানীয় সাংসদ ও দলীয় প্রভাবশালী নেতাদের হাত ধরে তাদের আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত ক্ষমতাসীন দলটির তৃণমূল।

একই সাথে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা এবং এমপি-মন্ত্রীরা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে স্থানীয় সরকারের সবগুলো নির্বাচনে একক প্রার্থী তালিকা পাঠান কেন্দ্র। তবে এবার সেই সুযোগ থাকছে না। তৃণমূলে কোন্দল নিরসনের পাশাপাশি কমপক্ষে তিনটি নাম কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড সদস্য মোহাম্মদ রশিদুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। প্রতিবার যে প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রার্থী বাছাই করা হয়। ইতোমধ্যে জেলা উপজেলা আ.লীগের দায়িত্বশীল নেতারা সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আ.লীগ একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অধিকাংশ নেতাকর্মীর দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু সবাইকে তো দলীয় মনোনয়ন দেয়া সম্ভব নয়। ত্যাগী, পরিশ্রমী এবং সাধারণ ভোটারদের মাঝে গ্রহণযোগ্য, এমন নেতাকেই নৌকার মনোনয়ন দেয়া হবে। এ জন্য তৃণমূলে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’

অপকর্মের সাথে যুক্ত নেতাদের মনোনয়ন দেয়া হবে না জানিয়ে আ.লীগের মনোনয়ন বোর্ডের এই সদস্য বলেন, ‘দলের অনেক নেতা আছেন। যারা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে দল ও সরকারের সুনাম নষ্ট করেছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তাদের কোনোভাবেই নৌকার টিকিট দেয়া হবে না।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘আগামী মাস থেকে সারা দেশে কয়েক ধাপে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপরই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। প্রতিটি নির্বাচনে জয়ের লক্ষ্যেই মাঠে নামবে আ.লীগ। এ জন্য সকল প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। গ্রহণযোগ্য ও ক্লিন ইমেজের প্রার্থীও খোঁজা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচনে তৃণমূল থেকে একক নাম কেন্দ্রে পাঠান। অনেক সময় স্থানীয় নেতারা ক্ষমতার প্রভাবে দেখিয়ে একক নাম পাঠায় কি-না সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েই দেখা হবে।’ কোনো বিতর্কিতদের নৌকার মনোনয়ন দেয়া হবে না বলেও জানান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের এই সদস্য।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও দলটির স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘আ.লীগ নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য এই দলের নেতাকর্মীরা সবসময় প্রস্তুত থাকে। স্থানীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’

নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে তিনটি বিষয় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে জানিয়ে আ.লীগের মনোনয়ন বোর্ডের এই সদস্য আরও বলেন, ‘ভোটের মাঠে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে প্রার্থী বাছাইয়ে আ.লীগ সবসময় সতর্ক। বিশেষ করে যারা মনোনয়ন পাবেন, তাদের স্থানীয় ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। দলের প্রতিটি নেতাকর্মীর সাথে সম্পৃক্ততা থাকতে হবে এবং জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।’

ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা এবং জেলা পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী ও দলের প্রভাবশালীরা একক নাম কেন্দ্রে পাঠান এবং তাদের দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে নানামুখী তৎপরতা চালান।

এদের বিষয়ে দলের ভূমিকা কী থাকবে— এমন প্রশ্নের জবাবে লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘কেউ ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে একক নাম পাঠাবে, তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ দেবে না, বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। তৃণমূল থেকে একক প্রার্থীর নাম পাঠানোর বিষয়ে যদি এমন কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়। তার বিরুদ্ধে সাথে সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হবে।’

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আমরা দেখেছি। তৃণমূল থেকে একটি নাম পাঠানো হয়। এদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগও আসে। কিন্তু এবার কমপক্ষে তিনটি নাম পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ত্যাগী, পরিশ্রমী এবং দুর্দিনে যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের মনোনয়ন দেয়া হবে।’

দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়ে ক্ষমতাসীন দলটির স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের এই সদস্য বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবেন। কেউ যদি তার সিদ্ধান্তের বাইয়ে গিয়ে ভোটের মাঠে কাজ করেন তাকে ছাড় দেয়া হবে না। তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

আ.লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং দলটির স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ড. আবদুস সোবহান গোলাপ বলেছেন, ‘জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকারের যেকোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলীয় প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। ওই সভায় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রতিবারের মতো আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে সেই ধারা অব্যাহত রাখতে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে আওয়ামী লীগ কাজ করে। এই দলের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা রয়েছে। তাই কোনোভাবে বিতর্কিতদের প্রার্থীরা করা হবে না। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।’

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *